বিবাহের সংঙ্গা

merrige
বিবাহ আরবী “নিকাহ” শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ।মুসলিম আইনে বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি বা লিখিত দলিল যাহা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়।পুরুষ এবং স্ত্রী এই উভয়ের মধ্যে সম্ভোগের এবং বৈধভাবে সন্তান লাভের জন্য অবাধ্য এবং চিরস্থায়ী যে বিধানিক চুক্তি (সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে) করা হয় তাকে নিকাহ বা বিবাহ বলে।

অর্থাৎ প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসায় পরস্পর আকৃষ্ট হয়ে সুখী জীবন ও বৈধ মিলনের মাধ্যমে সন্তানাদি জন্মদান করাই বিবাহের উদ্দেশ্য।

আরো পড়ুন : যেসব নারীকে বিয়ে করা হারাম

অপবিত্রতা এবং ব্যভিচার হতে মানুষকে রক্ষা করা তথা সন্তান উৎপাদন ও যৌথ মিলন বৈধকরণ এর উদ্দেশ্য বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।আইনগতভাবে একে একটি দেওয়ানি চুক্তি হিসাবে অভিহিত করা হলেও এটা ধর্মীয় কর্তব্যবোধ হতে বিদ্যমান। 

তাই শুধুমাত্র আইনগত দিক হতে নয় সামাজিক ও ধর্মীয় দিক হতে এর গুরুত্ব ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।সাথে সাথে বৈধ বিবাহের দুইজনে উপাদান ও বিভিন্ন প্রকার বিবাহের মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্যের মাধ্যমে প্রত্যেকের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা মূর্তমান হয়ে ওঠে।

আবার মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিবাহ বলতে ঐরূপ বিবাহকেই বোঝায় যে বিবাহে আইনের সকল প্রকার বিধান পালন করা হয়েছে এবং যেখানে আপত্তিকর কোন প্রশ্ন উথ্থাপিত হবে না।

ধর্মীয় বিধানঃ

অপবিত্রতা এবং ব্যভিচার হতে মানুষকে রক্ষা করা তথা সন্তান উৎপাদন ও যৌথ মিলন বৈধকরণের উদ্দেশ্যে বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে আদিষ্ট হয়েছে। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি মাত্র কোনো রূপ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা না হলেও শুধুমাত্র আইনগত দিক হতে নয় সামাজিক ও ধর্মীয় দিক হতেও এর গুরুত্ব ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

বিবাহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিভিন্ন লেখকগণ যেভাবে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন-

Fyzee বিবাহের সংজ্ঞায় বলেন,-“বিবাহ হলো এমনই একটি চুক্তি যার মাধ্যমে যৌন সঙ্গম ও সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়া বৈধ হয়।”

D. F. Mulla বলেন,-“বিবাহ হলো এমনই একটি যুক্তি যার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো বৈধভাবে সন্তান লাভ ও প্রতিপালন”।

আরো পড়ুন : রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কি কি

Abdul Kadir VS. Salima নামক মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি   Mahmood বলেন,-“মুসলিম আইনে বিবাহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটা একটি বিশুদ্ধ দেওয়ানী চুক্তি এবং বিবাহ পড়াবার সময় যদিও কুরআন শরীফ পড়ানো হয়, তবুও ঐ সময় যে কুরআন পড়তে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন-যাপন এবং বৈধ সন্তান জন্মদান করা হলো বিবাহের উদ্দেশ্য।”

সুতরাং কার্যকারিতার দিক হতে মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানি চুক্তি। সে কারণে চুক্তির যে সকল উপাদান কার্যকর হয় সেই সকল উপাদান মুসলিম বিবাহে ও কার্যকর হয়।

বিবাহের ফলে স্বামীর উপর স্ত্রীর যেমন-কতিপয় আইনগত অধিকার সৃষ্টি হয় তেমনি স্ত্রীর উপর ও স্বামীর কতিপয় আইনগত অধিকার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ উভয়ের মধ্যেই পারস্পরিক অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সৃষ্টি হয়।

সর্বোপরি বিবাহের ফলে সৃষ্ট আইনগত অধিকার কোন এক পক্ষ কর্তৃক লঙ্ঘিত বা ক্ষুন্ন হলে অপরপক্ষ স্বীয় আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন।

বৈধ-বিবাহের ফলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিবাহের উদ্দেশ্য এর দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে,-“মুসলিম বিবাহ দেওয়ানি চুক্তি ও পবিত্র বন্ধনের এক সমন্বয়।

বৈধ (সহিহ) বিবাহের অপরিহার্য উপাদান বা শর্ত সমূহঃ

মুসলিম আইনের বিধান মোতাবেক একটি বিবাহের (সহীহ) নিম্নলিখিত উপাদান বা শর্ত থাকা আবশ্যক।যথা-

১)বিবাহের যোগ্যতাঃ

বর ও কনের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। অর্থাৎ মুসলিম আইনের বিধান মোতাবেক বর এবং কনেকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্ক এবং সাবালক হতে হবে। অর্থাৎ পুরুষের ক্ষেত্রে ২১ বৎসর এবং নারীর ক্ষেত্রে ১৮ বৎসর পূর্ণ না হলে বর্তমান বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী বিবাহযোগ্য হবে না।

২)বিবাহের প্রস্তাবঃ 

মুসলিম আইনের বিধান মোতাবেক একটি বিবাহ সম্পন্ন করতে হলে বিবাহ ইচ্ছুক পক্ষবৃন্দদের মধ্যে যেকোনো একপক্ষ থেকে বিবাহ করার প্রস্তাব আসতে হবে। মুসলিম আইনে একে “ইজাব” বলা হয়।

৩)প্রস্তাব গ্রহণঃ 

একইভাবে বিবাহের অন্য পক্ষ কর্তৃক প্রস্তাব গৃহীত হতে হবে। মুসলিম আইনে একে “কবুল” বলা হয়। মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

আরো পড়ুন : নামাজভঙ্গের কারণ

৪)ইজাব ও কবুল একই বৈঠকে সম্পন্ন হতে হবেঃ 

এছাড়াও মুসলিম বিবাহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিবাহের প্রস্তাব ও কবুল একই বৈঠকে সম্পন্ন হতে হবে। এক বৈঠকে ইজাব এবং অন্য বৈঠকে কবুল দ্বারা বিবাহ সিদ্ধ হয় না।

৫)বিবাহের সাক্ষীঃ 

বিবাহের প্রস্তাব পেশ এবং গ্রহণ সাক্ষীদের সম্মুখে হতে হবে।হানাফী আইন মোতাবেক দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মনা পুরুষ অথবা তদ্রূপ একজন পুরুষ এবং দুইজন মহিলা সাক্ষী থাকা আবশ্যক।

৬)ভাষাঃ

বিবাহের প্রস্তাব ও গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত ভাষা এরূপ সঠিক ও সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যাতে বুঝা যায় যে, বিবাহ চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে।এক্ষেত্রে কোনরুপ দ্ব্যার্থবোধকতা বা দ্বিমত থাকলে ঐ বিবাহকে সিদ্ধ বিবাহ বলা যায় না।

৭)দেনমোহরঃ 

বৈধ বিবাহের অন্যতম উপাদান হিসেবে দেনমোহরের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম আইন মোতাবেক দেনমোহর হল স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসেবে স্বামীর উপর একটি অর্পিতা দায়িত্ব। অবশ্য দেনমোহর ধার্য না করে কোন বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে ঐ বিবাহ বৈধবিবাহ হিসাবে স্বীকৃত হবে না এবং সে ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে যথাযথ ও ন্যায় সঙ্গত দেনমোহর পাবার অধিকার লাভ করবে।

৮)নিষিদ্ধ সম্পর্কঃ

বিবাহের পক্ষগণকে অবশ্যই নিষিদ্ধ সম্পর্ক বহির্ভূত হতে হবে।কেননা মুসলিম আইনের বিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ পক্ষগণের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে ওই বিবাহ অবৈধ বলে গণ্য হবে।নিষিদ্ধ সম্পর্ক বলতে মাতা, কন্যা, ফুফু, বোন ইত্যাদি আরীয়ের সাথে সম্পর্ক কে বোঝায়।

৯)রেজিস্ট্রেশনঃ 

বৈধ মুসলিম বিবাহ সম্পাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান হল রেজিস্ট্রেশন। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইনের ৩ নং ধারা মোতাবেক অন্য কোন আইন, রেওয়াজ ও প্রথায় যায় থাকুক না কেন মুসলিম আইন অনুযায়ী সম্পন্ন প্রতিটি বিবাহ এই আইনের বিধান অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

আরো পড়ুন : সহবাসেরনিয়ম নীতি

বিবাহের যোগ্যতাঃ-

যে কোন সাবালক সুস্থ্যমনা মুসলমান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।পূর্বে মুসলিম আইনে বিবাহের ক্ষেত্রে পণের বৎসর পূর্ণ হলে সেই ব্যক্তিকে সাবালক বলে গণ্য করা হতো।কিন্তু বর্তমানে ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হবার পর একজন পুরুষ ২১ বছর এবং একজন নারী ১৮ বছর পূর্ণ না হলে সে বিবাহযোগ্য হবে না। 

উক্তা বয়সের নিম্নে বিবাহ সম্পন্ন করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। আবার পাগল এবং যৌবনাবস্থাপ্রাপ্ত নহে এমন নাবালক ব্যক্তি কিন্তু বর্তমানে ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ৪, ৫, ৬ নং ধারা অনুযায়ী নাবালকের বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কোন ব্যক্তি বল প্রয়োগ করে অথবা প্রবঞ্জনা করে কাহারোও সম্মতি আদায় করলে উক্ত বিবাহ অবৈধ বলে গণ্য হবে। তবে যার কাছ থেকে এইভাবে সম্মতি আদায় করা হয়েছে তিনি যদি পরে বিবাহ অনুমোদন করেন তাহলে তা অবৈধ হবে না। কিন্তু যে নারীর কাছ থেকে আদৌ সম্মতি গ্রহন করা হয়নি, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী যদি তার সাথে যৌন সঙ্গম করে তাহলেও উক্ত বিবাহ বৈধ হবে না।

বৈধ বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ

মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে যে সকল আইনগত ফলাফল লক্ষ্য করা যায়,তা হল-

১)এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর গৃহে বসবাসের, ভরণ পোষণ লাভের এবং অবিলম্বে পরিশোধনীর মূওজুল এবং বিলম্বে পরিশোধনীর মুঅজিল উভয়প্রকার মোহরানা লাভের অধিকারী হয়।

২)এরূপ বিবাহের মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে আনুগত্য, বিশ্বস্ততা এবং শারীরিক কারণ ব্যতিরেকে সকল অবস্থায় সহবাসের অধিকার প্রাপ্ত হয়ে সন্তান জন্মের বৈধতা স্বীকৃত হয়।

৩)এইরূপ বিবাহের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের সম্পত্তির অংশ পাওয়ার অধিকারপ্রাপ্ত হয়।

আরো পড়ুন : পুরুষও মহিলার নামাজের পার্থক্য

৪)বৈধবিবাহের ফলে স্ত্রীর উপর স্বামীর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়।

৫)বৈধবিবাহ বলবৎ থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, কথোপকথন ইত্যাদি সাধারণ প্রকাশ থেকে বিরত করার জন্য আইনগত অধিকার জন্য।

৬)বৈধ বিবাহের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর উভয়ের মধ্যে স্থাপিত আইনানুগ চুক্তি সমূহ বাধ্যতামূলক হয়।

৭)বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যু ঘটলে স্ত্রীকে অবশ্যই “ইদ্দত” পালন করতে হবে।

কিছু কথা:

আপনারা এই আলোচনাগুলোর মাধ্যমে উপকৃত হলে,বেশি বেশি করে শেয়ার করবেন আপনাদের বন্ধুদের মাঝে,যাতে করে তারাও জায়গা জমি আইন সম্পর্কে জানতে পারে।আমি শামীম মুক্তার শ্রীপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এর দলিল লেখক।আপনারা জায়গা জমি সম্পর্কে কি ধরনের তথ্য জানতে চান তা কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানান।জায়গা জমির আইন জানুন আপনার নিজের জমিকে নিরাপদ রাখুন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করে অপরকে জানার সুযোগ করে দিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url